অমিয়াখুম ও একটি স্বপ্ন পূরণের
গল্পঃ
প্রথম পর্ব ঃ চকরিয়া থেকে রেমাক্রি
“স্বপ্ন পথে যাত্রা”
পাহাড়ের
প্রতি আমার পুরানো প্রেম। মনে পড়ে পাহাড়ের সাথে প্রথম সাক্ষাত সেই ১৯৯৬ সালে, যখন
আমি মাত্র ক্লাস ৮ এর ছাত্র। পিকনিকে কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে গিয়েছিলাম। প্রথম
দর্শনেই প্রেম যাকে বলে। কিন্তু প্রথম প্রেমকে আলিঙ্গন করতে গিয়ে চপেটাঘাতও খেতে
হয়েছিল। অভিজ্ঞতার অভাব হলে যা হয়। প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে প্রেমিকার ভাইয়ের হাতে
মার খাওয়ার মত অবস্থা আর কি- পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম পাহাড় থেকে। সে যাত্রায়
অল্পের উপর দিয়ে গেলেও, পাহাড় জয় করার উদগ্র বাসনা পেয়ে বসলো আমাকে। সেই থেকে
শুরু, আজ অবধি একটুও ভাটা পড়েনি সেই উদ্যমে। দিন দিন বয়স বাড়ছে, অস্থিসন্ধি দুর্বল
হচ্ছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চশমার পাওয়ার। কিন্তু পাহাড়ের প্রতি আমার সেই প্রেম
প্রথম দিনের মত এখনও অম্লান। সেই দায় থেকেই প্রতি বছরই বেড়িয়ে পরি কোন না কোন নতুন
পাহাড়ের সন্ধানে। সঙ্গী হিসাবে প্রিয় বন্ধু রমেলের থাকাটা বের হয়ে পড়ায় অণুঘটক
হিসেবে কাজ করে।
আমাদের
এবারের যাত্রা দেবতার পাহাড় জয় করে অমিয়াখুম জল প্রপাতের দিকে, সাথে উপরি পাওনা
হিসাবে দিম পাহাড়, সাঙ্গু নদী, নাফাখুম আর ভেলাখুম। অমিয়াখুমের কথা প্রথম শুনি সেই
২০১০ সালে থানচি বাজারের এক মাছ বিক্রেতার কাছে। মাত্রই তখন তা জিং ডং পাহাড় জয়
করে ফিরেছি। নাফাখুমের দিকে চলার প্রস্তুতি হিসাবে থানচি বাজারে সদাই পাতি সংগ্রহ
করতে গিয়ে পরিচয় অমিয়াখুমের এক জেলের সংগে। কথায় কথায় তার কাছ থেকেই শুনেছিলাম
অমিয়াখুম আর সাত ভাই খুমের গল্প। তখন নাফাখুমই দুর্গম গন্তব্য আর অমিখুমের কথা না
হয় নাই বললাম। যাই হোক সে যাত্রা নাফাখুম জয় করেই খান্ত দিয়েছিলাম ( সে গল্প
আপনাদের আগেই শুনিয়েছি)। কিন্তু মনের মধ্যে একটা সুতিব্র বাসনা বয়ে চলেছি এই দীর্ঘ ৮ বৎসর ধরে। এর আগে
তিনবার চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি ভ্যাগের বিড়ম্বনায় আর প্রকৃতির দুর্বিপাকে। প্রথমবার
চেষ্টা করেছিলাম ২০১৪ সালে বাংলাদেশের স্বীকৃতি না পাওয়া সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সাকা হাফং
জয়ের পর। কিন্তু বৃষ্টির বাধায় থাইকং পাড়ায় দুইটা দিন নষ্ট হওয়ায় সে যাত্রা আর
অমিয়াখুমের দিকে যাওয়া হয়নি। দ্বিতীয় প্রচেষ্টা একই বৎসর সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু
এবার নাফাখুম পার হওয়ার পর জিনা পাড়ার পথে রোমেলের পা ভাঙল। অগত্যা কি আর করা সেই
যাত্রায় ফিরতি পথ ধরলাম। সেই ফিরতি যাত্রায় আহত সঙ্গীকে নিয়ে ফেরাটাও কম রোমাঞ্চকর
ছিল না। সে বর্ণনা হার মানাবে যে কোন রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজকেও। সেটা অন্য কাহিনী,
শোনাবো অন্য কোন উপলক্ষে। তৃতীয় চেষ্টা ২০১৬ সালের অক্টোবরে। ঢাকা থেকে যথারীতি
রওনা হলাম। প্ল্যান ছিল আমার স্ত্রী আর পুত্রকে ভাটিয়ারী মিলিটারি একাডেমীতে
শ্যালিকার হাওলা করে আমরা বান্দরবনের দিকে যাত্রা করব। কিন্তু এবার বিধি বাম।
ভাটিয়ারী পৌছতে না পউছতেই শুরু হল প্রচণ্ড বৃষ্টি। টানা দুই দিন ধরে চলা বৃষ্টি
সমস্ত উদ্যম মাটি করে দিল। বান্দরবন থেকে আমাদের গাইড সুফল জানাল প্রচণ্ড বৃষ্টিতে
রেমাক্রি খালের পানি বেড়ে যাওয়ায় এযাত্রা অমিয়াখুম যাত্রা বাদ দিতে হবে। অগ্যতা
সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়, ইকো পার্ক আর সহস্র্য ধারা ঝর্না আর মিলিটারি একাডেমী
ঘুরেই ফেরত আসলাম। ২০১৬ পেরিয়ে ২০১৭ পড়ল, নতুন চাকরিতে ছুটির বাধ্য বাধকতা অনেকটা পায়ে
বেড়ি পরিয়েই রেখেছে। এর মধ্যেই মাঝে মাঝে চেষ্টা করি জেলখানার শিক গলে নিজেকে
মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়িয়ে দিতে। এবার ডিসেম্বার মাসে প্ল্যান ছিল আন্দামান ঘুরে
আসার, আমার দল বলও সেই অনুযায়ী তৈরিই ছিল। কিন্তু বাধ সাধল চাকুরির ছুটি সংক্রান্ত
নতুন নীতিমালা – এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে দুইবারের বেশি দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না।
এই বৎসর অলরেডি দুইবার বহিঃ বাংলাদেশ ছুটি কাটিয়েছি তাই আন্দামানের চিন্তা এ
যাত্রা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হোল। বিকল্প চিন্তা হিসাবে দেশের মধ্যেই কোথাও ঘুরে
আসার প্ল্যান করলাম। অনেকগুলি বিকল্প থেকে সবার সম্মতিতে বেছে নেয়া হোল অমিয়াখুমকেই।
এর আগে একবার দেশের সর্বোচ্চ সড়ক আলিকদম-থানচি ঘুরে আসার সুযোগ মিস হওয়ায়, এইবার
প্ল্যান করলাম চকরিয়া, লামা আলিকদম হয়ে নতুন রাস্তা ধরে থানচি পৌছব। পরে সেখান
থেকে পদ্ম ঝিরি ধরে থুইসা পাড়া হয়ে অমিয়াখুম। কিন্তু বেশ কয়েকজন সঙ্গী পরিবার নিয়ে
যোগ দিতে চাওয়ায় এবং তাদের শারীরিক সামরথের বিবেচনায় পদ্ম ঝিরি বাদ দিয়ে রেমাক্রি
হয়ে নাফাখুম দিয়ে যাওয়ার প্ল্যাব চূড়ান্ত করা হোল। এবার ট্যুরের প্রস্তুতি। আরাফ
আর লামার রাসেল ভাইয়ের সহয়তায় বাসের টিকেট, চকরিয়া- থানচি জীপ ঠিক করে ফেললাম।
প্রথমে ঠিক ছিল ৩২ জন যাবে, কিন্তু শেষতক গ্রুপ ২৩ জনে গিয়ে ঠেকল। ১২ তারিখ রাতে
আমরা ১৭ জন ঢাকা থেকে রওনা দিলাম আর ৬ জন কক্সবাজার থেকে পরদিন সকলে চকরিয়ায়
আমাদের সাথে যোগ দিল। সকাল ৮টা নাগাদ চকরিয়ায় পৌঁছে লোকাল হোটেলে নাস্তা সেরে
নিতেই দলের বাকি ছয়জন যোগ দিল। এবার দুই জিপে করে রওনা দিলাম থাঞ্চির উদ্দ্যেশে।
প্রথম যাত্রা বিরতি আলিকদমে। এখানে জিপ থেকে নেমে রাস্তার পাশের হোটেলে চা আর গরম
সিঙ্গারা খেয়ে নিলাম। এই সুযোগে গাড়ির ড্রাইভার গারিতে তেল ভোরে নিল।
আলিকদম বাজার |
আবার যাত্রা
শুরু। দলের অর্ধেক সদস্যই জিপের ছাদে। আলিকদম- থাঞ্চি রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগই
মুখ্য উদ্দেশ্য। সত্যই উপভোগ করার মতই চারপাশের দৃশ্য। গাড়ি কখনও চড়াইয়ে উঠছে আবার
পরখনেই নামে যাচ্ছে পাহাড়ের গা বেয়ে। রাস্তার দুই পাশেই গভীর খাদ। তাকালেই পেটের
ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠে। বার বার মনে হয় এই বুঝি কয়েক হাজার ফিট নিচে পড়ে
যাচ্ছি, ভাবতেইতো ভয়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠে। পথের চারপাশ আসলেই বইচিত্রময়।
কোথাউ সবুজ গাছের সারি, কোথাও বা জুমের ফসল তোলার পর পুড়িয়ে দেয়া ন্যাড়া পাহাড়,
আবার কোথাও পথ পাশের ছোট্ট পাহাড়ি পাড়া আর সেখান থেকে দুই চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে
তাকিয়ে থাকা উপজাতি শিশু।
পথ পাশের পাহাড়ি পাড়া |
মাঝে দুই যায়গায় আর্মি ক্যাম্পে নেমে নাম পরিচয় লিপিবধধ
করে আবার রওনা হতে হোল। মাঝে একটা যায়গা পাহাড়ের চড়াই এতটাই খাড়া যে প্রায় ২০
মিনিটের মত গাড়ি প্রথম গিয়ারে চালাতে হল। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি স্টার্ট বন্ধ
হয়ে গাড়ি পাহাড় থেকে গরিয়ে পড়ে। কিছু দূর পর পর দেখা মিলছিল এই পথে নিয়মিত
চলাচলকারী মোটর বাইক আরোহীদের সাথে। মনের ভেতর একটা হিংসাও দানা বেধে উঠছিল- ইসস
আমি যদি এই রকম মোটর বাইকে এই পাহাড়ি পথে ঘুরে বেরাতে পারতাম। তবে মনকে এই বলে
সান্ত্বনা দিলাম অন্তত জিপের ছাদে করে তো ঘুরে বেরাতে
পারছি।
পথের দুই পাশে অসংখ্য নাম না জানা গাছের
সমারহ। কিছু গাছ অবশ্য পরিচিত। তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছাতিম। লম্বা একহারা
গড়নের গাছ, একেবারে মাথায় কদম ছাঁট দেয়ার মত বেশ কিছু ডাল পালা আর পাতা। আর সাথে
রয়েছে বক সাদা থেকে ইলিশ রুপালি রং ধারন করা কাশ ফুলের সারি।
তন্ময় হয়ে উপভোগ
করছিলাম প্রকৃতির এই উদার সৌন্দর্য। দেখতে দেখতে ডিম পাহাড় পেড়িয়ে বেলা দুইটার
দিকে পৌঁছলাম থাঞ্ছিতে। সেখানকার বি।জি।বি। ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করিয়ে সীমান্ত
অবকাশ রিসোর্টে দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থা। বেশ সুন্দর ছিমছাম এই সীমান্ত অবকাশ
রিসোর্ট। পাহাড়ের উপর বেশ কয়েকটি বাংলো আর হানিমুন কটেজ নিয়ে কয়েক মাস হোল যাত্রা
শুরু করেছে নতুন এই হলিডে ডেসটিনেশন। পরিবার নিয়ে একটা গোটা দিন কাটিয়ে দেয়ার জন্য
বেশ আদর্শ যায়গা। এখানকার খাবারের মানও খুব ভালো, সাথে বি জি বি সদস্যদের আন্তরিক
আথিতেয়তার তো তুলনাই হয়না। লাঞ্চ সেরে সব কিছু গুছিয়ে রওনা দিতে আমাদের প্রায়
তিনটা বেজে গেল।
রেমাক্রি পর্যন্ত আমাদের গাইড লাল পিরান দা, যিনি আবার আমাদের
পূর্ব পরিচিত। দলের অধিকাংশ সদস্যদের এইবারই প্রথম রেমাক্রি যাত্রা, তাই সবাই বেশ
উৎফুল্ল। চারটি ইঞ্জিন বোটে করে আমরা মোট ২৩ জন রওনা দিলাম রেমাক্রির উদ্দেশ্যে।
তখন বেলা প্রায় চারটা। আমার সবচেয়ে প্রিয় জার্নি সাঙ্গু নদী ধরে আপস্ত্রিম যাত্রা।
পদ্ম মুখ, তিন্দু, বড় পাথর পার হয়ে যখন রেমাক্রি পৌঁছলাম ততখনে সূর্য পাটে বসেছে।
গোধূলির ম্লান আলোয় পাহাড়ের গায়ে রেমাক্রির কটেজগুলিকে অপার্থিব মনে হচ্ছিল। আস্তে
আস্তে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছিল, আমরাও যার যার রুমে পৌঁছে ব্যাগ রেখে চেঞ্জ করে
নিলাম। রাত যত বাড়ছিল সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল শিতের তীব্রতা। কিন্তু সব কিছু
উপেখখা করে চলছিল আমাদের আড্ডা। সেই সাথে দলের নতুন সদস্যদের সাথে পূর্ব অভিজ্ঞতার
ভাগাভাগি। এর মধ্যে লাল পিরান দা খবর দিল রাতের খাবার রেডি। একসাথে সবাই বসা যাবে
না। তাই দুই ভাগে ভাগ করে রাতের খাবার সেরে চা খেয়ে, রেমাক্রি বাজারে কিছুখন আড্ডা
দিলাম। কিন্তু শিতের তীব্রতা বেড়েই চলছিল। বাধ্য হয়ে কটেজে ফিরে সোজা স্লিপিং
ব্যাগের ভেতর। ...... চলবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন