মঙ্গলবার, ২০ জুলাই, ২০২১

কর্ণফুলী নদীর উৎসমুখের সন্ধানে হরিনার পথে

 

Horina day 1 for blog

 

বৃষ্টির সাথে আমার চির বৈরিতা। লোকজন বৃষ্টি নিয়ে রোমান্টিক পোস্ট দিলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। এতবার বৃষ্টি আমার ট্যুরগুলিতে থাবা বসিয়েছে যে বৃষ্টির নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসে। যথারীতি এবারও এর ব্যাতিক্রম নেই। হরিণা ট্যুরের সবকিছু ঠিক করে যাওয়ার আগের দিন থেকেই বৃষ্টি শুরু হোল। যেন তেন বৃষ্টি নয়। নিম্নচাপের অসহ্য সারাদিন ভরে বৃষ্টি, থামার কোন নামগন্ধ নেই। ওয়েদার ফোরকাস্ট বলে সামনের তিনদিনও বৃষ্টির হানা অব্যাহত থাকবে। ট্যুরের শুরুতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। পুজার ছুটির কারনে একদিন ছুটি নিলেই পুরা চারদিনের ছুটি মিলে যায়। এবার তাই দলও বেশ ভারি। সব মিলিয়ে ২০ জন। বহু কষ্টে ২০ টা টিকেট ম্যানেজ করলাম। তাও পিছনের সীট এভয়েড করার জন্য দুই বাসে টিকেট কাটলাম। সেশ মুহুর্তে একজনের আত্নীয় বিয়োগ হওয়ায় দলের মেম্বার ১৯ এ ঠেকলো।

 

 

ব্যাগ গোছানোর পালা

 

 

দলের একাংশ

 

 যথাসময়ে যাত্রা শুরু হোল। দলের একজন সিলেট থেকে যাত্রা করেছে। বাস ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু তিনি এখনও নরসিংদী। অন্য সময় বাস দেরী করে কিংবা রাস্তায় জ্যাম থাকে। আজ আশ্চর্জ্জনক ভাবে একদম ঠিক সময়ে বাস ছেরে দিল আর তার চেয়েও বেশি আশ্চর্য রাস্তায় জ্যামের নামগন্ধ নেই। প্রথম বাস যথারিতি হাসান ভাই কাচপুর ব্রিজ পৌছার আগেই ক্রস করে গেল। পরের বাসে রোমেল জরুরি প্রকৃতির ডাকে সারা দেওয়ার কথা বলে প্রায় ২০ মিনিট বাস দাড় করিয়ে রেখে হাসান ভাইকে তুলে নিল।

 

 পথে কুমিল্লা আর চট্টগ্রামে যাত্রা বিরতি দিয়ে রাঙ্গামাটি পোউছলাম ঠিক ভোর সারে ৪ টায়। বাস থেকে নামলাম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে কিছুদুর হেটে আপাত গন্তব্য ডি সি অফিসের বিশ্রামাগারে পৌঁছলাম। সেখানে ফ্রেশ হয়ে নিতেই নাস্তা হাজির। নাস্তার পর কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে ডি সি অফিসের ঘাট থেকেই নৌকায় চরলাম। বেশ বড় ইঞ্জিন বোট, সাথে টয়লেটও আছে আপতকালীন কাজ সাড়ার জন্য। আগামী তিনদিন বেশিরভাগ সময় নৌকাতেই থাকতে হবে তাই আশান্বিত হলাম। ঝুম বৃষ্টিতে নৌকার ছাদে বসা যাচ্ছিল না। ছাতা নিয়ে যে দাড়াবো তারও উপায় নেই। প্রচন্ড বাতাসে ছাতাতো উলটে দেয়ই, পারলে আমাদের শুদ্ধ উরিয়ে ফেলে, সেই সাথে নৌকার দুলুনি তো আছেই। পথে এক বাজার থেকে বাজার সদাই করে আর চা খেয়ে আবার রওনা দিলাম। বৃষ্টীতে কিছু করার নেই, অনেকেই নিচের ডেকে দেখি ঘুমের এন্তেজাম করছে। কয়েকজনকে তো দেখলাম দিব্যি নাক ডাকছে।

 

বৃষ্টির কাছে অসহায়

পি পি ই এর সদ্বব্যবহার

বৃষ্টিতে নাকাল, ডেকে ঊঠা যাচ্ছে না

বাজারে নেমে রসদ সংগ্রহের চেষ্টা


হায়রে বৃষ্টি

দেখতে দেখতে একে একে পার হয়ে এলাম শুভ্লং আর বরকল। বরকলে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে ক্যান্টিনে জিলাপি ছলা আর মুড়ি খেয়ে বরকল বাজার একটু ঘুরে দেখে আবার রওনা দিলাম। এবার যেন প্রকৃতিদেবি কিছুটা প্রসন্ন হলেন। বৃষ্টি কিছুটা ধরে আসলে বোটের ডেকে শুর হোল আড্ডা আর ফোটোশেশন। গল্পে গল্পে অনেকটা বেলা পার হয়ে এসেছে, পেড়িয়ে এসেছি অনেকটা পথ। বৃষ্টি থামায় কিছুটা সুযোগ পেলাআম প্রকৃতি উপোভোগের।

 

 

বড়কল

বড়কল




 

 

 

 হরিনার কথা প্রথম শুনি ২০১৪ সালে। সেই থেকেই প্রতিবছর প্ল্যান করি, কিন্তু প্ল্যান আর বাস্তবায়ন হয় না। এবারো জুলাই মাসে প্ল্যান করে বৈরি প্রকৃতির কারনে পিছিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম যা হয় হোক যাবই যাব। বন্ধু রোমেলকে বলে রেখেছিলাম কেউ না গেলেও মরা দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়বো। চারদিনের ছুটি মিলে যাওয়ায় আর দেরী করি নাই। পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে জেনে আর নেট ঘেটে অপ্রতুল কিছু তথ্য নিয়ে বেরিয়ে পরা । দলের বাকিরা সত্যি অর্থে জানেই না কোথায় যাচ্ছি। আমার আর রমেলের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে ঘর ছেড়েছে সবাই। ইভেন পরের দুইদিন কথাও যাব, কোথাও থাকবে সেই সম্পর্কেও সবাই ছিল অন্ধকারে। যাই হোক সকালটা বৃষ্টি মাটি করে দিলেও এখন প্রকৃতিদেবী তার রূপ রস গন্ধ সব যেন উজার করে ঢেলে দিলেন। দুই পাশের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে কর্নফুলি নদী। নদীর উজান বেয়ে চলেছি আমরা। গন্তব্য কর্নফুলির উৎসমুখ, মানে যেখান থেকে মিজোরামের লুসাই পাহার থেকে নেমে হরিনার ঠেগামুখ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে রুপসি এই নদী। গত তিনদিনের টানা বৃষ্টির কারনে পাহাড়ী ঢলে নদীর পানি বেশ ঘোলা, তারপরও সৌন্দর্যের কওন কমতি নেই। দু ধারে উচু পাহাড়, কোথাও কোথাও পাহাড়ের উপরে বসতি চোখে পড়লো। কোথাও মাইলের পর মেইল কোন লোকজনের দেখা নাই। দুধারে শুধু সবুজ পাহাড় আর পাহাড়। বৃষ্টীস্নাত সবুজ পাহাড় চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। কোথাও থেকে থেকে জেলেরা জাল পেতে রেখেছে। মাঝে একটা চ্যানেলের মত পার হয়ে এলাম। এর মধ্যে আরাফ, রাসেল ভাই, হাসান ভাই আর মেহেদি মিলে চানাচুর মাখার আয়োজন করে ফেলেছে সেই সাথে ঝাল্মুড়ি। সত্যি লাইফ ইজ বিউটিফুল। এই অনুভুতি লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব না।

 

 





 

 

 

 

 

 বোটের ওপেন ডেকে মৃদুমন্দ বাতাসে প্রকৃতির এই রূপ আর এই অপার্থিব খাওয়া দাওয়া। সৃষ্টীকর্তার শুকরিয়া আদায় করলাম। চ্যানেল পেড়িয়ে বার কর্নফুলি নদিতে উঠলাম। এখানে নদী বেশ চওড়া। পাহাড় ছেড়ে কিছুটা সমতল দুইপাশ সেই সাথে চিরচেনা গ্রাম বাংলার দৃশ্য। বেশ কিছুটা সময় অতিক্রান্ত করলাম গল্পগুজব আর ফটোশেশনে। এর মধ্যে আবার প্রকৃতি আবার বিরূপ হওয়ায় আবার সবার ঠাই হোল নিচের ডেকে। পথে ভূষনপুর বি জি বি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে আরো প্রায় চল্লিশ মিনিটের মত পথ অতিক্রম করে পৌছলাম ছোট হরিণা বাজারে। বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লাগোয়া এই গ্রাম। যার দরুন সিকিউরিটির অত্যন্ত বাড়াবাড়ি। এলাকার লোক আমাদের দেখে বেশ অবাকই হলেন। আসলে এখানে কোন ট্যুরিষ্ট আসে না। এই বাজার আশে পাশের গ্রাম গুলির একটা মিলনস্থল। সবাই এখানে বাজার করতে আসে। প্রতি বৃহস্পতিবারে এখানে হাট বসে। দূর দুরান্ত থেকে লোকেরা তাদের জুম চাষের পন্য নিয়ে আসে এখানে বেচা কেনার জন্য। এখান থেকেট্রলার যোগে পন্য চলে যায় রাঙ্গামাটিতে, সেখান থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাঙ্গামাটির সবচেয়বড় কলার বাজার বসে এখানে। সেই সাথে মিলতে পারে আনারস আর কমলা এবং পেপে। রাঙ্গামাটির সমতা ঘাট থেকে প্রতিন সকাল ৭টা, ১০টা আর বেলা দুইটায় লোকাল লঞ্চ ছেড়ে আসে। একই ভাবে এখান থেকেও প্রতিদিন তিনটা লঞ্চ ছেড়ে যায়। সময় লাগে কম্বেশি ৭ থেকে ৮ ঘন্টা। চাইলে স্পীডবোটেও আসা যায়, সেক্ষেত্রে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। কিন্তু প্রকৃতি বিরূপ থাকলে স্পীডবোট এভয়েড করাই ভালো। প্রায়শই ঝোরো বাতাসে স্পীড বোট উলটে দুর্ঘটনা ঘটে। হরিনা বাজারের পাশেই ছোট হরিন গ্রাম। কয়েক ঘর মানুশ নিয়ে এই গ্রাম। বাঙালি আর পাহাড়িরা মিলে মিশে বাস করে এই গ্রামে। এইখানে একটা বি জি বি ক্যাম্পে আছে। আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল বাজারের একমাত্র লজে। এই রিমোট যায়গায় লজ মানে বুঝতেই পারছেন। কল্পনা করে নিন বর্ননা আর নাই দিলাম। তবে লজের লোকেশন এক কথায় অসাধারন। সামনে বয়ে চলেছে খড়স্রোতা কর্নফুলী নদী আর দুইপাশে সবুজ পাহাড়। প্রকৃতির প্রেমে পরতে আর কি লাগে। লজে লাগেজ নামিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাজারের হোটেলে লাঞ্চ সেরে নিলাম। একটু গড়িয়ে নিয়ে বি জি বি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে এলাম। এরপর বাজ দোকানে আড্ডা চলল রাত ৯ টা পর্যন্ত। রাতের খাবার খেয়ে নদীর পাড়ে রাত বারটা পর্যন্ত চলল দ্বিতীয় দফার আড্ডা......।। চলবে



































কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন