মঙ্গলবার, ২০ জুলাই, ২০২১

 কর্ণফুলী নদীর উৎস মুখের সন্ধানে দ্বিতীয় দিন ( হরিনা থেকে কাট্টলি বিল হয়ে লঙ্গদু)


প্রকৃতির বিরূপতায় কালকের সারাটা দিন একরকম নষ্টই হয়েছে। যদিও প্রকৃতির এই রুপেরও আলাদা একটা মাধুর্য আছে, তবে এই মাধুর্য চায়ের কাপ নিয়ে প্রিয়ার সাথে বসে ব্যাল্কনিতে উপভোগ করার মত। চলতি পথে এই বিরূপতা প্রকৃতি উপভোগে বাধাই শুধু সৃষ্টি করে না সেই সাথে মনকেও বিক্ষিপ্ত করে দেয়। কালকের প্রকৃতির বিরূপতায় বিক্ষিপ্ত মন নিয়েই ঘুমাতে গিয়েছিলাম। খুব ভোরে এলার্ম দেয়া থাকলেও তার আর প্রয়োজন পড়লো নয়া। ভোর সারে পাচটা থেকেই পল্টুনের লঞ্চের ভেপুর শব্দে আর ঘুমানো গেল নয়া। কাল সারারাত ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। রাতে ভালো ঘুম হলেও আরেকটা দিন প্রকৃতির স্বেচ্ছাচারিতার কাছে সপে দিতে হবে ভেবে মন খারাপ করেই ঘুম থেকে উঠলাম। 

হরিনা ঘাটে হোটেলের বারান্দা থেকে আকাশ দেখা

হরিনা লঞ্চ ঘাট, ভোর ৬ টা

কর্নফুলী নদীর একদম পাড়ে লঞ্চ ঘাটের লাগোয়াই আমাদের আপাত আবাস, কর্নফুলি গেস্ট হাউস। চমৎকার লোকেশন, তিনদিকে পাহাড় আর এক দিকে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী। কিন্তু গেস্ট হাউসের করুন হাল আর প্রকৃতির এই অবস্থা খুব বেশি উপভোগের সুযোগ দিল না। ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিতেই দেখি বন্ধু রোমেলও উঠে পড়েছে। এমনিতে ট্যুরে গেলে আমার লাথি ছাড়া ও ঘুম থেকে উঠে না কিন্তু আজ লঞ্চের এমন জোরালো ভেপু যে রমেলের মত কুম্ভকর্ণকেও শয্যা ছাড়তে বাধ্য করেছে। ব্যালকনিতে গিয়ে আরেকদফা শঙ্কায় মন ভারি হয়ে গেল। পুরো আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা। যে কোন সময় ঝর ঝর ঝরে পরতে পারে। অগত্যা কি আর করা আর একবার স্লিপিং ব্যাগের ভিতর সেধিয়ে গেলাম। ঘুম আসলো না আর কিছুতেই।

 



রিজার্ভ বাজার থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চ

পাহাড়ি পাড়া

 স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকেই মাহমুদ ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে নাস্তার ডাক আসলে  অনেক কষ্টে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামলাম। সবাই দেখি নাস্তা করে নিয়েছে, আমি আর মাহমুদ ভাই শুধু বাকি। নাস্তা করতে করতে হরিনার প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিনয় কৃষ্ণ চাকমা বাবু এসে উপস্থিত। উনিই আমাদের এখানে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। অনেক্ষন উনার সাথে চায়ের কাপ সহ আড্ডা দিচ্ছিলাম আর জেনে নিচ্ছিলাম এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা আর আশে পাশের প্রকৃতি সম্পর্কে। এখান থেকে খুব কাছেই ভারতের মিজোরাম বর্ডার, তাই সিকিউরিটির একটু বেশ বাড়াবাড়িই চলে। এখানে একটা বি জি বি ক্যাম্প আছে, আরেকটা আছে আরেকটু উজানে বড় হরিনায়। এর পর ঠেগামুখ, বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত গ্রাম, যেখান দিয়ে কর্ণফুলি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সীমান্ত সাময়িক উত্তপ্ত থাকায় আমাদের আর সেইমুখো হওয়া হোল  না। কথায় কথায় জানতে পাড়লাম চট্টগ্রাম বন্দর থেকে থেগামুখ পর্যন্ত রাস্তার প্ল্যান পাশ হয়ে আছে। ভারতীয় অংশের রাস্তাও তৈরি, বাংলাদেশের অংশের রাস্তা তৈরি হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পন্য রাঙ্গামাটি আর ঠেগামুখ হয়ে সরাসরি মিজোরাম চলে যাবে। ভারতীয় সরকার বাংলাদেশ অংশের রাস্তা তৈরির খরচ দিতেও প্রস্তুত, কিন্তু চিনের সংগে সাময়িক শীতল সম্পর্কের কারনে রাস্তা তৈরির কাজ আপাতত স্তগিত হয়ে আছে। এই রাস্তা হলে এখানকার জীবনযাত্রার মানের যে আমূল পরিবর্তন হবে সে কথা আর বলে দিতে হয় না। কিন্তু মনের মধ্যে এক অজানা আশংকাও তৈরি হোল, সেই সাথে এই প্রকৃতিও হারিয়ে যাবে নাতো। আজ আমাদের গন্তব্য বরকল আর কাট্টলি বিল পার হয়ে লংগদু পার হয়ে হরিনা। অনেক দুরের পথ। প্রায় ৭-৮ ঘন্টার জার্নী, তাই আমাদের গাইড কাম মাঝি প্রভিন চাকমা বার বার তারা দিচ্ছিলেন। কৃষ্ণদার সাথে আড্ডাটা সবে জমে উঠেছে আর এই সময় এই ডাকা ডাকি। কি আর করা দাদাও বুঝলেন অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই নিজে থেকেই উঠলেন। হোটেলে আর রেস্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে হরিনাকে বিদায় জানিয়ে আবার ১৯ জনের দল সবাই ট্রলারে চড়ে বসলাম। 

প্রকৃতিদেবী একটু সহায় হওয়ার সুযোগে

আকাশের আবার মুখ ভার হচ্ছে


আকাশের মুখ ভার

এই মেঘ এল বলে
 

সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল এবার কিছুক্ষনের জন্য যেন প্রকৃতিদেবী একটু সদয় হলেন। রোদ না ঊঠলেও বৃষ্টির যন্ত্রণা বন্ধ হলো। সবার মুখেই একটু সস্থির হাসি। আবার ট্রলারের ডেকে আড্ডা আর ফটোশেসন শুরু হল। একেকজনের একেক ভঙ্গিমায় ছবি দেখতে দেখতে পেরিয়ে এলাম অনেকটা পথ। পথে ভূষণছড়া আর বরকল বি জি বি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হল। মাঝে কিছুক্ষনের জন্য বৃষ্টি বাগড়া দিলেও মোটামোটি আজ প্রকৃতিদেবী প্রসন্নই ছিলেন। বরকল পার হওয়ার পর রীতিমত রোদেরও দেখা মিললো। এবার কর্নফুলি নদীর ভাটীর দিকে আমাদের যাত্রা। নদীর দুইধারে সবুজ গাছে ছাওয়া পাহাড়ের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। আল্লাহের কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম নিজের দেশের এই রকম অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগের সুজোগ করে দেওয়ার জন্য। অনেকে অনেক টাকা খরচ করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়া যায়, তাদেরকে আমি বলবো এর চেয়ে বিশগুন কম খরচে দেশের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন আপনি। আশা করি আশাহত হবেন না।

ভূষনছড়া

প্রকৃতিদেবী সহায় হওয়ার সুযোগ নেয়া

বড়কলের কাছাকাছি

ফিরতি যাত্রা

অবাক করা সৌন্দর্য

দলের একাংশ

জীবনযাত্রা

বড়কল


 

 

 এর মধ্যেই রাসেল ভাই আর আরাফ মিলে গত দিনের মত চানাচুর আর মুড়ি মাখিয়ে ফেললো। সবাই মিলে ওপেন ডেকে প্রকৃতি উপভোগ আর সেইসাথে এই রাজকীয় খাওয়া, সত্যি আমরা ভাগ্যবান। কয়জনের কপালে জুটবে এই সুখ। 






 

এর মধ্যে সময় বাচাতে আমাদের মাঝি একটা বাইপাসের ভিতর দিয়ে নৌকা পার করে নিয়ে এলেন। এখানে পানির গভীরতা আর স্রোতের তীব্রতা কিছুটা কম। এর মধ্যেই হাসান ভাই আর একজন লাইফ বয়া সহ ট্রলার থেকে দিলেন লাফ আর বাকিরা ব্যাস্ত হয়ে পড়লো এই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতে। এর মধ্যেই বাকিদের বায়না সবাই পানিতে নামবে। কিন্তু প্রভিন দা সাফ মানা করে দিলেন এইখানে পানির গভীরতা বেড়ে গেছে, স্রোতের তীব্রতাও অনেকখানি, তাই নামা যাবে না। 

 

লেকের পানিতে ঝাপ দেওয়ার প্রস্তুতি

দলের একাংশ

লেকের পানিতে

 


 

এর মধ্যে পোউছে গেলাম দশ নাম্বার বলে একটা যায়গায়। এখানে থেকে থেকে কাপ্তাই লেকের বুকে ছোট ছোট নাম না জানা দ্বীপের মত। কোনকোনটাতে মানুষের বসতি থাকলেও বেশির ভাগই জন মানবহীন। এই রকমই একটা দ্বীপের গায়ে নৌকা ভিড়ালেন প্রভিন দা। এখানে নামা যাবে। কিন্তু নেমে পড়লাম আরেক বিপত্তিতে। দ্বীপের চারপাশে কাটা ঝোপের জঙ্গল। কিছু আবার পানিতে ডোবা। অতি উৎসাহী কয়েকজন তারতারি নামতে গিয়ে পা কাটার আঘাতে রক্তাক্ত করলো। অবশেষে দ্বীপের বিপরীত দিক দিয়ে পানিতে নামলাম। এখানেও কাটা ঝোপ আছে তবে পরিমানে কম। একে একে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে সবাই পানিতে নামলো। বেশ কিছুক্ষণ চললো লেকের পানিতে হুটোপুটি। এই অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভভ না। চারপাশে পাহাড়ের মাঝে এই দিগন্ত বিস্তৃত লেকের পানিতে গোসোল করা সত্যিই ভ্যাগ্যের ব্যাপার। সবাই এক ব্যাক্যে স্বীকার করে নিল যে টাকা খরচ করে থাইল্যান্ড গিয়েও বোধহয় এত মজা করা যেত না। 

কাট্টলি বিলের পথে




 

আমাদের আরো অনেকটা সময় এখানে কাটানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু প্রভিন দা ত্বারা দিলেন, এখনও যে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তারপর মাঝপথে কাট্টলি বিল পড়বে, যেখানে ঝরো বাতাস হলে নৌকা উল্টে যেতে পারে। অগত্যা আর কি করা অতৃপ্ত মন নিয়ে আবার ট্রলারে চড়লাম। মাঝে কাট্টলি বিল আর কাট্টলি বাজার পার হয়ে যতক্ষনে লংগদু পৌঁছলাম ততক্ষনে সুর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। ... চলবে














লেক থেকে কেনা মাছ, অসাধারণ স্বাদের