অনেকদিন বন্ধুরা মিলে কোথাউ যাওয়া হচ্ছে না। জীবন
জীবিকার চাপে পিস্ট, যান্ত্রিক জীবনের যান্ত্রিকতায় ক্লেদাক্ত জীবন থেকে একটু
ছুটির জন্য হাঁসফাঁশ করছি এই অবস্তায় দীর্ঘদিনের বন্ধু রোমেলের ফোনে মনটা নেচে
উঠল। ওরও আমার মত একই অবস্থা। সামনে দুইদিনের বন্ধ, শুক্রবার আর ১৭ই মার্চ
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তাই সায় দিতে আর দেরি করলাম না। এবার প্ল্যান রেডি করে
ফেললাম। প্রথমে সন্দ্বীপ ঘুরে বাশবাড়িয়া আর মহামায়া লেক ঘুরে ঢাকায় ফেরত। আমাদের
অন্যান্ন টুঁরে সাধারণত ২০ থেকে ৩০ জনের দল হয়ে যায়। এতবর দলের পরিচালনা করতে গিয়ে
প্রায়শই আমাদের নিজেদের ভ্রমণটা উপোভোগ্য হয় না। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন চাহিদা
মেটাতে আর অভিযোগের সামাল দিতে নিজেরাই মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যাই। তাই এবার
সিধান্ত নিলাম খুব কাছের দুই তিন জন ছাড়া কাউকে কিছু বললাম না। সবমিলিয়ে পাঁচ জন।
আমি, রোমেল, রোমেলের ৭ বৎসর বয়সী ছেলে রাফি, সিলেটের হাসান ভাই আর রেশাদ ওরফে
গোল্লা। টানা দুইদিনের ছুটি তাই টিকেট পেতে একটু বেগ পেতে হলেও ১৫ তারিখ
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১ টার ৫ টা টিকেট যোগার করা গেল। নির্ধারিত দিনে সবাই যথা
সময়ে বাস স্ট্যান্ডে উপস্থিত। বাস আসতে বেশ দেরি, এই সুযোগে চারজনে মিলে ট্যুর
প্ল্যান গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। প্রথমে আমরা বাসে করে সীতাকুণ্ড পার হয়ে বড় কুমিরায়
নামব, সেখান থেকে সি এন জি করে কুমিরা ঘাট সেখান থেকে স্পিড বোটে প্রায় ৩০ মিনিটে
গুপ্তছরা ঘাট, সেখান থেকে সি এন জি বা মোটর সাইকেল কিংবা ভ্যানে করে মূল শহরে।
সেখানে নাস্তা সেরে মোটর সাইকেলে ঘন্টা মাফিক দুই বা তিন ঘন্টায় পুরা দ্বীপ ঘুরে
দুপুরে পূর্ব পরিচিত একজনের বাসায় লাঞ্চ করে বিকেলের মধ্যে বাঁশবারিয়া বীচ হয়ে কুমিরা ফেরত এসে সীতাকুণ্ডে
রাত্রি যাপন। পরদিন মহামায়া লেক, নাপ্তিত্তা ছড়া, খইয়া ছড়া আর কমলদহ ঝর্না দেখে
রাতের বা বিকালের গাড়িতে ঢাকায় ফেরত। আগে যেহেতু চন্দ্রনাথ পাহাড় আর সীতাকুণ্ড ইকো
পার্ক, সহস্র ধারা, সুপ্ত ধারা ঝর্না ঘুরে এসেছি তাই এ যাত্রা আর সেগুলো ঘুরব না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয়
আরেক, বিধাতা বোধহয় তখনই মিটি মিটি হাসছিলেন। নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১৫ মিনিট পর
কলাবাগান কাউন্টার থেকে বাস ছাড়ল। ঘড়ির কাটা প্রায় ১২ টা ছুই ছুই। টি টি পাড়া
পর্যন্ত রাস্তা একরকম ফাঁকাই ছিল। বিপত্তিটা বাঁধল এর পর পরই। প্রচণ্ড ট্র্যাফিক
জ্যাম। কাচপুর ব্রিজ উঠতে উঠতে রাত প্রায় আড়াই টা। সেখান থেকে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত
দীর্ঘ যানবাহনের সারী। মেঘনা ঘাট যখন ক্রস করলাম তখন দেখি ফজরের আজান হচ্ছে। আমি
প্রায় ৫০ বারের মত ধাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে পার হয়েছি, কিন্তু কখনই এধরনের বিরূপ
পরিস্থিতির মুখে পরতে হয়নি। যাত্রা বিরতি হোল কুমিল্লায় সকাল তখন আটটা। বড় কুমিরায়
যখন নামলাম তখন সকাল সাড়ে দশটা। আকাশ কিছুটা মেঘলা দেখে মনটা একদিকে ভাল যে
সূর্যের খরতাপে পুরতে হবে না কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আরেকদিকে মনটা কু ডাক
ডেকে উঠছিল যদি পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। যাই হোক দোলচালে দুলতে দুলতে ব্যাটারি চালিত
অটো রিকশায় করে কুমিরা ঘাটে পৌঁছলাম।
যা ভাবছিলাম তাই। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কোন
স্পীড বোট ছেড়ে যায় নি। অনেকেই সকাল থেকে সিরিয়ালে নাম লিখিয়ে বসে আছেন সেই সকাল ৭
টা থেকে। এই সুযোগে আপনাদের সাথে কিছু তথ্য শেয়ার করে নেই। কুমিরা থেকে সন্দ্বিপের
গুপ্তছরা ঘাটে যেতে স্পীড বোট, ছাড়াও সার্ভিস বোট (বড় ট্রলার) মালের ট্রলার, আর
একধরেন ইঞ্জিন নৌকা আছে। সার্ভিস বোটের ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা, স্পীড বোটের ভাড়া
২৫০ টাকা। দুইধরনের স্পীড বোট আছে ২০ জনের আর ১০ জনের। আপনারা দলে বেশি হলে স্পীডবোট
রিজার্ভ করে নিতে পারেন। কুমিরা ঘাট ছাড়াও, ছোট কুমিরা নেমে বাশবারিয়া সি বীচ হয়ে
স্পীড বোটে কিংবা চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে ষ্টীমারে সন্দ্বীপ আসতে পারেন। কিন্তু
বর্তমানে সদরঘাট থেকে সার্ভিসটি বন্ধ রয়েছে।
আমি টিকেট কাউন্টারে পৌঁছে দেখি সেখানে অপেক্ষামান
লোকেদের বিশাল ভীর, কিন্তু কাউন্টারে কেউ নেই। সকাল থেকে অপেক্ষা করে থাকা লোকেদের
বিরক্তি চরমে উঠেছে, তার মধ্যে কাউন্টারের লোকেদের নির্লিপ্ত আচরণ তাদের
বিরিক্তিকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। কেউ সঠিক কোন ইনফরমেশনও দিতে পারছিল না।
অবশেষে একটা সার্ভিস বোট এসে ঘাটে ভিরলে জানা গেল, সার্ভিস বোটের টিকেট পাওয়া
যাবে। আমি যেহেতু কাউন্টারের কাছেই ছিলাম সহজেই টিকেট পেয়ে গেলাম। স্পীড বোটের
অনিশ্চয়তায় না থেকে টিকেট নিয়ে ট্রলারে উঠে বসলাম। আগে আগে টিকেট কাটার কারণে
ট্রলারের ছাদে সামনের দিকের সবচেয়ে লোভনীয় জায়গাগুলিই পেলাম।
ট্রলার ছাড়তে কিছুটা
দেরি হবে এই সুযোগে ইন্টারনেটে ঢুঁকে সন্দ্বীপ সম্পর্কে কিছু তথ্য আহরণ করে নিতে
ভুললাম না। আপনি চাইলে নিচের লিংকে ক্লিক করেও তথ্য গুলি পেতে পারেন।
“সন্দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত চট্টগ্রাম
জেলার অন্তর্গত উপজেলা। এটি বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটি দ্বীপ।
ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাসে
জানা যায় যে সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছরের অধিককাল ধরে লোক বসতি বিদ্যমান। এমনকি
এককালে এর সাথে সংযুক্ত থাকা নোয়াখালীতে মানুষের বসতি স্থাপনের পূর্বেই সন্দ্বীপে
জনবসতি গড়ে উঠেছিল। সন্দ্বীপের লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্র শিল্প পৃথিবী
খ্যাত ছিল। উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা
এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করতেন এবং সহজ বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং পরিবহন সুবিধাদি
থাকায় এই অঞ্চলে ব্যবসা এবং বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। ১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে
জানা যায়, প্রতি বছর সন্দ্বীপে উৎপাদিত প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে
করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত।
সন্দ্বীপ এককালে কম খরচে
মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মানের জন্য পৃথিবী খ্যাত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই
জাহাজ রপ্তানি করা হতো। তুরস্কের সুলতান এই এলাকার জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এখান
থেকে বেশ কিছু জাহাজ কিনে নেন। ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর।
লবণ ও জাহাজ ব্যবসা, শস্য সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে
পর্তুগিজরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেন। এছাড়া ভ্রমণ ও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে
ফরাসি ও ওলোন্দাজ পরিব্রাজকরা প্রায়ই সন্দ্বীপে আগমন করতেন। ১৬১৫ সালে পর্তুগিজদের
সাথে আরকান রাজ্যের যুদ্ধে ২০০ জন সৈন্য সহ পর্তুগীজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত
হয় এবং পর্তুগিজরা সন্দ্বীপ ত্যাগ করলে ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখল করে। এরপর সন্দ্বীপে
আরকান ও মগদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের পরাধীনতাকে অস্বীকার করে একে প্রায় অর্ধ শতাব্দী
শাসন করেন দেলোয়ার খাঁ। ১৬৬৬ সালে তাঁর রাজত্বের পতন ঘটে এবং মোগল সরকারের অধীনে জমিদারদারী
প্রথার সূচনা ঘটে, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়। রূপে
মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে। ১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে
ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপে আসেন। ১৫৬৫ সালে ডেনিশ পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক
সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ননা লিপিবদ্ধ করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের
২৮শে জানুয়ারী মোজাফ্ফর আহমেদের
সাথে সন্দ্বীপে আসেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী
নজরুল ইসলাম।[সন্দ্বীপ
ভ্রমণের সময়কার স্মৃতির পটভূমিকাতেই কাজী
নজরুল ইসলাম তাঁর মধুবালা গীতিনাট্য রচনা করেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে
বসে নজরুল তাঁর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন।
সন্দ্বীপের নামকরণ
নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়। কারও কারও মতে বার আউলিয়ারা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এই দ্বীপটি জনমানুষহীন অবস্থায় আবিস্কার করেন এবং
নামকরণ করেন 'শুণ্যদ্বীপ', যা পরবর্তীতে 'সন্দ্বীপে' রুপ নেয়। ইতিহাসবেত্তা
বেভারিজের মতে চন্দ্র দেবতা 'সোম' এর নামানুসারে এই এলাকার নাম 'সোম দ্বীপ'
হয়েছিল যা পরবর্তীতে 'সন্দ্বীপে' রুপ নেয়।কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে 'স্বর্ণদ্বীপ' আখ্যা প্রদান করেন। উক্ত 'স্বর্ণদ্বীপ' হতে 'সন্দ্বীপ' নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়। দ্বীপের নামকরণের আরেকটি মত হচ্ছে পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিগণ বাংলাদেশে আগমনের সময় দূর থেকে দেখে এই দ্বীপকে বালির স্তুপ বা তাদের ভাষায় 'স্যান্ড-হীপ' (Sand-Heap) নামে অভিহিত করেন এবং তা থেকে বর্তমান 'সন্দ্বীপ' নামের উৎপত্তি হয়।
সন্দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি
বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বকোণে ২২°১৬´ থেকে ২২°৪৩´ উত্তর অক্ষাংশ
এবং ৯১°১৭´ থেকে ৯১°৩৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে মেঘনা
নদীর মোহনায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম উপকূল ও সন্দ্বীপের মাঝখানে সন্দ্বীপ চ্যানেল
অবস্থিত। চট্টগ্রাম
জেলা সদর থেকে নদীপথে প্রায়
৫০ কিলোমিটার দূরে এ উপজেলার অবস্থান। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের দূরত্ব প্রায় দশ মাইল। নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ১২ মাইল পশ্চিমে
অবস্থিত। সন্দ্বীপের প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপের অবস্থান। সন্দ্বীপের সীমানা হচ্ছে পূর্বে
সন্দ্বীপ চ্যানেল ও চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে সীতাকুণ্ড
উপজেলা ও মীরসরাই
উপজেলা, উত্তরে বামনী নদী, পশ্চিমে
মেঘনা নদী ও তারও পশ্চিমে নোয়াখালী
জেলার হাতিয়া
উপজেলা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের
আয়তন প্রায় ৬৩০ বর্গমাইলের হলেও ক্রমাগত নদী ভাঙনের কারণে বর্তমানে এটি মাত্র ৮০
বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। সন্দ্বীপের দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কিলোমিটার)
ও প্রস্থ ৩-৯ মাইল (৫-১৫ কিলোমিটার)
বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চল
থেকে সন্দ্বীপ উপজেলায় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। মোট নৌপথ ২২ নটিক্যাল মাইল।
দ্বীপ থেকে মূল ভুখণ্ডে যাতায়াতের জন্য রয়েছে বি.আই.ডব্লিউ.টি সি. এর ২টি স্টীমার
ঘাট এবং ৫টি জেলা পরিষদ ফেরীঘাট। এছাড়াও এ উপজেলার অভ্যন্তরে সড়ক যোগাযোগের জন্য
৭৩ কিলোমিটার পাকারাস্তা, ১৯ কিলোমিটার আধা-পাকারাস্তা ও ৮৬২ কিলোমিটার কাঁচারাস্তা
রয়েছে।“
এরই মধ্যে দেখি ট্রলার
পুরাই কানায় কানায় পূর্ণ। আর দেরি না করে মাঝি ট্রলার ছেড়ে দিল, আর শুরু হোল উত্তাল
বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলে আমাদের যাত্রা। ধীরে ধীরে পার হয়ে এলাম কুমিরা ঘাটের
বিশাল জেটি, শিপ ব্রেকিং এরিয়া। এর পরই শুরু হোল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। প্রথমে আনন্দদায়ক
হলেও কিছুক্ষণ পর ঢেউ বাড়লে অনেকেই দেখি বমি করছে। কিন্তু আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায়
খুব একটা সমস্যা হোল না।
গল্প গুজব, আড্ডা আর খাওয়া দাওয়ায় কখন যে দেড় ঘণ্টা পার হয়ে
গেল টেরই পেলাম না। আস্তে আস্তে দৃষ্টিগোচর হোল গুপ্তছরা ঘাট। ভাটার সময় ট্রলার ঘাটে
ভিরবে না, তাই ছোট ইঞ্জিন নৌকায় জনপ্রতি ১০
টাকা করে দিয়ে ঘাটে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আপনি চাইলে মোটর সাইকেল, ভ্যান বা সি এন জি তে করে মূল শহরে পৌছতে পারেন। আমরা সোজা
হাটা দিলাম। পাশের একটা হোটেল পেয়ে গরম গরম রসগোল্লা, দেশি কলা আর ডাবের পানি দিয়ে
হালকা নাস্তা করে আবার হাঁটা দিলাম।
মেঘলা
আবহাওয়ায় হাটতে বেশ ভালই লাগছিল। কিছুদূর গিয়ে গুপ্তছরা বাজারে গিয়ে সেখান থেকে সি
এন জি নিয়ে চললাম আমাদের আপাত গন্তব্য আজমপুরের দিকে, পথে পার হয়ে এলাম মূল উপজেলা
শহর। শহর বলতে কয়েকটা পাকা দালান্ উপজেলা সদর, আদালত, কয়েকটা আবাসিক অনাবাসিক হোটেল,
বাজার আর মার্কেট। আমরা আমাদের নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেখি আমাদের পূর্ব পরিচিত আবু
বকর সাহেব আমাদের জন্য বিশাল আয়োজন করে রেখেছেন। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে পেটে ক্ষুধা থাকায়
বেশি বাক্যব্যয় না করে খাবারের উপর রীতিমত ঝাপিয়ে পড়লাম। তিন ধরনের শাক, তিন ধরনের
ছোট মাছ, মুরগির ঝাল ফ্রাই, গরুর কালা ভুনা, টোম্যাটো আর চিংড়ি মাছ দিয়ে বানানো চাটনি
আর শেষে মহিষের দই। সব মিলিয়ে লাস্ট কবে আড়াই প্লেট ভাত খেয়েছি মনে করতে পাড়ছিলাম না,
আজ তাই হোল। শেষে আবার সুন্নত অনুযায়ী কিছু ফল মুখে দিয়ে এক কাপ গরুর দুধের চা খেয়ে
তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম। এ সময় ঢাকা থেকে আমার স্ত্রীর ফোন। আমার ৫ বৎসর বয়সী ছেলে জাতীয়
পর্যায়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে, আগামীকাল পুরষ্কার বিতরণী।
এ রকম একটা আনন্দের দিনে তার পাশে উপস্থিত না থাকলে কি আর হয়। অগত্যা সিধান্ত নিলাম
আজকেই ফিরব। খাওয়া দাওয়ার পর কিছু সামাজিক কাজ করে মোটর সাইকেলে করে কিছুক্ষণ পুরা
দ্বীপটা ঘুরে দেখলাম। সবচেয়ে আকর্ষিণীয় ছিল দ্বিপের পশ্চিম দিকের সমুদ্রতট। সেখানে
কিছুটা সময় কাটিয়ে এবার ফিরতি পথে রওনা দিলাম।
কিন্তু ঘাটে পৌঁছে দেখি বিধি বাম। আমার
চোখের সামনে দিয়েই দিনের সেশ সার্ভিস বোটটি ছেড়ে গেল সেই গানের মত “আমার বলার কিছু
ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে”।
আবহাওয়া প্রতিকুল থাকায় এই ঘাট থেকে আর কোন স্পীড বোট ও ছেড়ে যাবে না। ঘাটের অনেকের
সাথে ফেরার প্রয়োজনীয়তা শেয়ার করার পর একজন বুদ্ধি দিল পাশের বাশবারিয়া ঘাট থেকে স্পীড
বোটে করে ছোট কুমিরার বাঁশবারিয়া ঘাটে যাওয়া যায়, ফোন নাম্বারও দিলেন। বেশ কয়েকবার
ব্যর্থ চেস্টার পর ঘাটের ইজারাদার ফোন ধরলেন, কিন্তু মন খারাপ করে বলে দিলেন আজকের
মত সেশ স্পীড বোটটি ছেড়ে গিয়েছে। অগ্যাতা কি করা মন খারাপ করে গুপ্তছরা ঘাটে বসে চা
খেলাম আর সূর্যাস্তের অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।
এ সময় বাঁশ বারিয়া ঘাটের ইজারাদার
আবার ফোন করলেন, রিজার্ভ করলে একটা স্পীড বোট পাওয়া যেতে পাড়ে, ভাড়া লাগবে ২৫০০ টাকা।
সিধান্ত নিতে এক মুহূর্তও দেরি করলাম না। তিনটা মটোর সাইকেলে করে রওনা হলাম বাঁশ বারিয়ে
ঘাটের দিকে। কিন্তু রাস্তা এত খারাপ যে প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে
পড়ে যেতে পাড়ি। অবিরাম ঝাঁকি খেতে খেতে কোমরের যে অবস্থা হয়েছিল, তা না হয় আর নাই ই
বললাম। ঘাটের কাছাকাছি গিয়ে দেখি একটা বাঁশের সাকো পার হতে হবে, কিন্তু সেটা ভেঙ্গে
পড়েছে, মেরামতের কাজ চলছে। নিচে এত পরিমান কাদা যে হেটে পার হওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ
অপেখ্যা করে সেই ভাঙ্গা সেতু দিয়ে চার হাত পা ব্যবহার করে কোন রকমে পার হলাম। স্পীড
বোটে যখন যাত্রা শুরু করলাম ততক্ষণে রীতিমত অন্ধকার। আবার সেই উত্তাল সাগর। এবার যেন
ঢেউ এর ঝাপটা আরও বেশি, মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে উলটে যেতে পাড়ে বোট। এদিকে সময়
আর পার হয় না। স্পীড বোটের পানির ঝাপ্টায় শরীরের একপাশ ভিজে চুপসা হয়ে আছে।
অবশেষে
আধ ঘন্টা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম ছোট কুমিরার বাশবারিয়া ঘাটে। সেখানে এক কাপ চা খেয়ে
সি এন জি করে মেইন রোডে এসে বাসে করে চিটাগাং শহরে। সেখানে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের আতিথ্য
গ্রহণ করলাম। তার ওখানে রাতের খাবার খেলাম আর বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকার উত্তেজনাময় নিধাহাস
ট্রফির গ্রুপ পরবের সেশ ম্যাচ দেখে রাত ১১.৫০ এর বাসে ঢাকার দিকে রওনা দিলাম।